সাপখেকো বাজ
প্রজনন মৌসুমে যে পাখিটি ঊর্ধ্বাকাশে উঠে বৃত্তাকারে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে আনন্দে মিষ্টি সুরে ডাকাডাকি করে, প্রেমিক-প্রেমিকা আকুল হয়ে বিমানের ‘ডগ ফাইট’-এর কৌশলে পরস্পরকে ধাওয়া করে এবং যে পাখি-দম্পতি কেবল উড়তে শেখা বাচ্চাদের নিয়ে ওড়ার মহড়া করায় ওই ঊর্ধ্বাকাশেই বিন্দু হয়ে, আনন্দে চেঁচিয়ে আশপাশের সবাইকে জানান দেয়, ‘দেখ দেখ, আমাদের বাচ্চারা উড়তে শিখেছে, বুক ভরা আনন্দ তাই আজ আমাদের;’ সেই পাখিটিই যখন প্রবল আক্রোশ ও কৌশলে বিষধর কেউটে বা গোখরো সাপ শিকার করে নখরে গেঁথে উড়াল দেয়, তখন যেন ধন্দ লেগে যায়। এমনিতে শিকারি এই পাখি চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে; মাঠ-বিলের কিনারের কোনো গাছের ডালে, নারকেল-তালগাছের পাতার ওপরে, বিদ্যুতের খুঁটি বা এ রকম কোনো জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে।
যেকোনো ধরনের সাপ নজরে পড়লেই হলো, ধেয়ে যাবে। সুকৌশলে গাঁথবে নখরে, বসবে এসে গাছের ডালে। দুই পা ও ঠোঁট ব্যবহার করে মারবে শিকার। খাবে তারপর। অবশ্য খোলা জায়গা না হলে বিষধর সাপকে এরা ঘাঁটায় না পারতপক্ষে। কিন্তু খোলা জায়গা হলে আক্রমণে যাবেই। বিষধর সাপ কি আর হার মানে সহজে! কিন্তু এই পাখিও ওস্তাদ শিকারি। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে ঢাল-তলোয়ার-বল্লমযুদ্ধের কৌশল একই সঙ্গে খাটাতে পারে দুই পাখা, দুই পা ও ঠোঁট ব্যবহার করে। বিষধর সাপকে সে পরাজিত করে। সাপ এই পাখির ছায়া দেখলেই ভীত হয়ে পড়ে। এ রকম লড়াই আমি অনেকবার দেখেছি। এই ২০১০ সালেও তিন জোড়া পাখি বাসা করেছিল আমার গ্রাম বাগেরহাটের ফকিরহাটে। একই গাছে বছরের পর বছর ফিরে আসে এরা। পুরোনো বাসায় নতুন কিছু উপকরণ এনে ডিম পাড়ে, বাচ্চা তোলে। ডিম বেশ বড়, গোলগাল ধরনের। বহু পুরোনো একটি ডিমও আমার সংগ্রহে আছে। ডিম পাড়ে এক থেকে দুটি। দুজনই তাতে তা দেয়। ডিম ফোটে ২৮-২৯ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ৪০ দিনের ভেতর।
প্রিয় খাবার এদের সাপ। তা ছাড়া হাঁস-মুরগির ছানা, গুইসাপের বাচ্চা, অঞ্জন, তক্ষক, ইঁদুর, কাঁকড়া, বেজির ছানা ইত্যাদি। মাছ এদের আদৌ প্রিয় খাবার নয়। নিতান্তই পেটের দায়ে পড়ে খায়। ও রকম মাছ খাওয়া একটি পাখিকে মেরে একেবারে ক্রুশবিদ্ধ করে টানিয়ে রাখা হয়েছিল আমার গ্রামের একটা মাঠে, ২০০৫ সালের আগস্টে। প্রাণিবিদ রেজা খান দৃশ্যটি দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। ও রকম মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি আগে আর দেখেননি। তবুও এরা আছে পুরো বাগেরহাট-ফকিরহাট এলাকায়। খুশিতে বা উত্তেজনায় এদের মাথার ছোট খোঁপাটি জেগে ওঠে।
শিকারি এই পাখির স্থানীয় নাম সাপখেকো বাজ, তিলাবাজ, খোঁপা ইগল ইত্যাদি। উড়লেই এদের শরীরের সৌন্দর্য খোলে। বসে থাকলে সাদামাটা লাগে। তীক্ষ দৃষ্টিশক্তি আর শিকার দক্ষতার সদ্ব্যবহার করেই এরা সাপ শিকার করে। শিকারের কৌশলটা অবশ্যই ধ্রুপদি। শিকার পায়ে নিয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য আরও মনোহর।
পাখিটির ইংরেজি নাম Crested Serpent Eagle, বৈজ্ঞানিক নাম Spilornis Cheela। মাপ ৭০ সেমি। স্ত্রী পাখিটি বড় হয়। ৭৭ সেমি পর্যন্ত পেয়েছি আমি। শরৎ-বসন্তে এদের বাচ্চাদের আকাশে উড়তে দেখা যায়। মাছ মুরালের (Grey-headed Fish Eagle) সঙ্গে এদের কোনো বিবাদ লাগে না। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে আমার গ্রামে এক জোড়া মাছ মুরালও ছানা তুলেছিল।
সাপখেকো বাজ এখনো টিকে আছে সারা দেশেই। বাগেরহাটসহ বৃহত্তর খুলনা এলাকায় বেশি দেখা যায়।
সাপখেকো বাজ
প্রথম আলো, শরীফ খান | তারিখ: ২৮-১২-২০১০
+ There are no comments
Add yours