টাঙ্গুয়ার হাওরে মহাশোল
মিঠা পানির অনেক মাছই আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। এক সময় এদেশের নদী-খালে-বিলে নানা প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। মামা-চাচাদের কাছে শোনা মাছ ধরার গল্প আজ কেবলই গল্প। এর মাঝেও হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া মাছ পাওয়া গেলে সম্ভাবনার আশা জাগায় মনে। সেরকমই একটি খবর দৈনিক প্রথম আলো ২০১০-০৭-২২ তারিখে প্রকাশ করে একটি খবর। নিসর্গের পাঠকদের জন্য এখানে তুলে রাখলাম। হারিয়ে যাওয়া মাছ মহাশোলের খবর পড়ুন বিস্তারিত। মূল খবরের লিংক এখানে। এই মাছ সম্পর্কে আরো জানতে উইকিপিডিয়াতে দেখুন।
[strong]আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ২২-০৭-২০১০ | প্রথম আলো[/strong]টাঙ্গুয়ার হাওরে মহাশোল মাছ! তথ্যটি আগ্রহোদ্দীপক। কারণ হাওরে এই মাছ থাকার কথা নয়। তবে দেশের মিঠাপানির বিলুপ্তপ্রায় এই সুস্বাদু মাছ পাওয়া গেল সেখানে। টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ধরা মহাশোলের পোনা জেলেরা বিক্রি করতে এনেছিলেন সুনামগঞ্জ বাজারে। সেখানকার মধ্যনগর বিপি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক সুধাংশু সরকার মাছটির ছবি তুলে পাঠিয়েছেন প্রথম আলোয়।
ছবি দেখে ঢাকায় মৎস্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাছটি যে মাহশোল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সঙ্গে এও জানিয়েছেন, টাঙ্গুয়ার এই মাছ তাঁরা এখন পর্যবেক্ষণ করবেন।
সুধাংশু সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মহাশোলের পোনাটি আট ইঞ্চি লম্বা। ওজন ৩০০ গ্রাম। ৪ জুলাই মাছটি মধ্যনগর বাজারে আসে। তিনি ৩০০ টাকায় মাছটি কিনেছিলেন। এবার বর্ষা শুরুর পর থেকে প্রায়ই টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ধরা একটি-দুটি করে মহাশোলের পোনা বাজারে আসছে খবর পেয়ে তিনি মাছটি কেনার চেষ্টায় ছিলেন। ৬ ও ১৯ জুলাইও প্রায় একই আকারের বেশ কয়েকটি মাছ বাজারে এসেছিল। প্রতি সপ্তাহেই দু-একটি করে মহাশোলের পোনা মধ্যনগর বাজারে উঠছে। তিনি জানতেন, মাছটি দেশ থেকে এক রকম বিলুপ্তই হয়ে গেছে। তাই এর ছবি তুলে স্থানীয় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান, স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা ও ঢাকায় প্রথম আলোয় পাঠিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘বিলুপ্তপ্রায় মাছটি যখন টাঙ্গুয়ার হাওরে পাওয়াই যাচ্ছে, তখন পোনা ধরা বন্ধ করে এর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি টাঙ্গুয়ার হাওরে যে পোনামাছ শিকার চলছে, তা বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
২০০৩ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় আছে। সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবে স্থানীয় প্রশাসন স্বীকার করেছে, একশ্রেণীর লোক চুরি করে মাছ শিকার করে এবং তারা মাঝে মাঝে ধরাও পড়ে।
মহাশোলের পোনা শনাক্ত করে মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অ্যাকুয়া কালচার) মৎস্য বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আরিফ আজাদ জানালেন, পাহাড়ি খরস্রোতা স্বচ্ছ পানির নদীতে মহাশোল মাছের আবাস। নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে ‘পেরিফাইটন’ নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই মহাশোলের প্রধান খাদ্য। মহাশোলের দুটি প্রজাতি। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Tor tor, অন্যটি Tor putitora. আমাদের দেশে দুই প্রজাতির মহাশোলই পাওয়া যেত। নেপালে পাওয়া যায় কেবল প্রথমটি। এ ছাড়া ভুটান, ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানেও মহাশোল আছে। মাছটি সাধারণত ৫২ সেন্টিমিটার লম্বা ও নয় কেজি পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে। তবে একটি বিস্ময়কর পুরোনো রেকর্ড আছে মৎস্য অধিদপ্তরে, বিশেষজ্ঞ থমাসের। তিনি ১৮৯৭ সালে ৬৮ কেজির একটি মহাশোল পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। মহাশোল সর্বোচ্চ ১৫ মিটার গভীর পানিতে চলাচল করতে পারে। পানির উষ্ণতা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাদের জীবনধারণের পক্ষে সহায়ক।
মহাশোল দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো। তবে এর আঁশগুলো আরও বড়। পরিণত মাছের আঁশ শক্ত, উজ্জ্বল সোনালি রঙের ও দীপ্তিমান। পাখনা ও লেজ রক্তিম। নাকের সামনে ছোট্ট দুটি গোঁফের মতো আছে। সব মিলিয়ে দেখতে খুব সুন্দর। আমাদের মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে কংস নদ ও সোমেশ্বরী নদী মহাশোলের আবাস। এই নদ-নদীর উৎসমুখ এখন প্রায় বন্ধ। শুকনো মৌসুমে নদী দুটি প্রায় শুকিয়ে যায়। বসবাস ও বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মহাশোল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একপর্যায়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। সোমেশ্বরী ও কংস ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে দু-একবার সাঙ্গু নদেও মহাশোল পাওয়া গেছে। তবে হাওর, বিল-ঝিল বা অন্য কোনো নদ-নদীতে মহাশোল পাওয়ার রেকর্ড নেই মৎস্য অধিদপ্তরে।
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরনা) এসে মিশেছে এই হাওরে। সুধাংশু সরকারের অনুমান, ওই পাহাড়ি ঝরা দিয়েই হয়তো কোনোভাবে মহাশোল টাঙ্গুয়ার হাওরে এসেছে।
স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে, মহাশোল মাছের টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার কথা নয়। মৎস্য বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আরিফ আজাদ জানালেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে জীবজগতের স্বাভাবিক আচরণগত বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন ঘটেছে। মাছের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। যেমন ইলিশ মাছের বিচরণক্ষেত্র ও স্বাদের পরিবর্তন ঘটেছে। মহাশোলের ক্ষেত্রেও এমন পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে মহাশোলের ক্ষেত্রে এ নিয়ে কোনো বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। তিনি জানালেন, মহাশোলের বংশ রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ হয়েছে। সেখানে সফলভাবে এর পোনা উৎপাদন করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পোনা মজুদও আছে।
পুকুরে মহাশোলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। পুকুরে মাছটির বৃদ্ধি খুবই ধীর। দুই বছরে দেড় থেকে দুই কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। এ কারণে মৎস্যচাষিরা বাণিজ্যিকভাবে মহাশোল চাষে উৎসাহিত হননি। তবে কেউ আগ্রহী হলে ময়মনসিংহের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পোনা সংগ্রহ করতে পারেন।
অবশ্য, সবকিছু কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে এমন তো কথা নেই। একটি প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখা—মানুষ শ্রেষ্ঠ বলে সেই দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়।
+ There are no comments
Add yours