বাঘ কেন লোকালয়ে হামলা করে
জঙ্গল থেকে বাঘ এসে লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে, মানুষজন আহত করছে, মারছে, গরু ছাগল-শুয়োর-কুকুর টেনে নিচ্ছে সুন্দরবনের বনসংলগ্ন লোকালয় থেকে। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বনপ্রান্তে জনবসতি গড়ে ওঠার সময় থেকেই বাঘের ‘প্রিডেটরি অ্যাবেরেসন’ হয়ে আসছে। এটা শুধু সুন্দরবনেই নয়, ভারতের দুধওয়া, কানহা, সুন্দরবন; ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে বাংলাদেশ সুন্দরবনের মতো এত বেশি মাত্রার উৎপাত পৃথিবীর বাকি ১৩টি বাঘের দেশের কোনোটিকে পোহাতে হয় না।
এবার একটু বুঝতে চেষ্টা করা যাক, কেন প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের বাঘ জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে হামলা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা যায়। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে চাঁদপাই রেঞ্জের জয়মনি বৈদ্যমারী, কাঁটাখালী, ধানসাগর এলাকার বনপ্রান্তবর্তী গ্রামগুলোতে একটি বাচ্চাওয়ালা বাঘিনীসহ চারটি বাঘ হামলা চালাত। বন বিভাগের সৌজন্যে এ সময় ওই এলাকাগুলোতে আমি ১০ দিন কাটাই। কেন এমন হচ্ছে সেটা জানতে চেষ্টা করি। পরবর্তী বছরগুলোতে সুন্দরবনের অন্যান্য এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা তদন্তের চেষ্টা করি। তদন্তে কেন বাঘ এমন আচরণ করছে, তার কিছু সুত্র পাই।
এলাকাগুলোর মধ্যে চাঁদপাই রেঞ্জ সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর এলাকা। ধানসাগর এলাকা থেকে লাউডোব এলাকা পর্যন্ত গত ২৫ বছরের এক বছরও বাঘের আক্রমণ থেমে থাকেনি। দ্বিতীয় স্পর্শকাতর এলাকা হচ্ছে বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের গোলখালী থেকে কৈখালী পর্যন্ত। তৃতীয় স্পর্শকাতর এলাকা শরণখোলার বগি থেকে ধানসাগর এলাকা। নলিয়ান রেঞ্জের বনিয়াখালী, মহেশ্বরীপুর, কদমতলা এলাকায় কখনো কখনো বাঘের হামলা হলেও এ রেঞ্জটি বেশ শান্ত। এ এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাত হয় চাঁদপাই রেঞ্জের জামনি এলাকায়, দ্বিতীয় হচ্ছে বুড়িগোয়ালিনীর দাতিনাখালী এলাকা।
বিভিন্ন সময়ে বাঘ আক্রান্ত গ্রামগুলোর আশপাশের জঙ্গল ঘুরে জানতে পেরেছি, একেকটি এলাকার অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কারণে বাঘের আক্রমণ ঘটলেও প্রধান কারণ, বাঘ ক্ষুধার তাড়নায় লোকালয়ে হানা দেয়। সাধারণত সুন্দরবনে বড় জলোচ্ছ্বাস হয়ে যাওয়ার কিছুকাল পরই বাঘ গ্রামে আশা শুরু করে। বাঘ গ্রামে হামলা করা শুরু করে এপ্রিলের মাঝামাঝি। বেশি করে মে-জুনে। শীতে হামলা কিছুটা কমে আসে।
কারণ খুঁজতে উদাহরণ হিসেবে চাঁদপাই রেঞ্জের ১৯৮৯ সালের ঘটনা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ১৯৮৯ সালের আগেও চাঁদপাই রেঞ্জের গ্রামে বাঘ বিক্ষিপ্ত কিছু হামলা করেছে। কিন্তু ওই বছর হামলা চলে প্রায় প্রতিদিন। ১৯৮৮ সালে পশর নদী বরাবর ধেয়ে আসা এক ঘুর্ণিঝড়ে মংলাসহ চাঁদপাই এলাকা জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যায়। বানের পানি নেমে গেলেও বেড়িবাঁধের মধ্যে বিপুল পরিমাণ পানি আটকে যায়। এ পানি আর সরানোর ফলপ্রসু চেষ্টা হয়নি। লবণজলে আটকে গিয়ে গ্রামীণ ঘাস, ঝোপঝাড় পচে গবাদিপশুর খাবার নষ্ট হয়ে যায়। জঙ্গল থেকে লোকালয়গুলো ছোট নালার আকারের খড়মাখাল দিয়ে বিভক্ত। গরু-মোষের মালিকেরা তখন তাদের পোষ্যগুলোকে খাল পার করে জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিত। এত বেশি এলাকা দিয়ে গরু-মোষ ঢোকানো হতো যে বন বিভাগের কর্মচারীদের পক্ষে ওই বিশাল এলাকা পাহারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। চাঁদপাইয়ের লোকালয়ের দক্ষিণের জঙ্গল স্থানীয় শিকারিদের সৌজন্যে প্রায় হরিণশুন্য। জঙ্গলের ভেতরে সোনামুখী বাঁওড় বলে একটি বিল আছে। আগেকার দিনগুলোতে বাঘ খাদ্য হিসেবে চিতল হরিণ, শুয়োর ওই এলাকায় পেত। উপরন্তু মায়া হরিণ, বানর, গুঁইসাপ, মাছ, কাঁকড়া খেয়ে স্বাদ বদল করতে পারত। জলোচ্ছ্বাসের পর হরিণ কমে যায়, বাকিগুলো গরু-মোষের উৎপাতে আরও দক্ষিণে চলে যায়।
তৃণভোজী প্রাণী উদ্বাস্তু হয়ে অন্য এলাকায় কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু মাংসাশীরা ভয়ঙ্কর রকম এলাকাকাতর। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে টাইগার প্রজেক্টের মাধ্যমে বাঘ বিশেষজ্ঞ সাইডেন যে কয়টি বাঘ জঙ্গলে স্থানান্তর করেছিলেন, ওদের সব কয়টি বাঘই স্থানীয় বাঘের হাতে নিহত হয়েছে−সে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। চাঁদপাই সুন্দরবনের বাঘেরা হরিণ-শুয়োরের অভাবে বাধ্য হয়ে জঙ্গলে ঢোকা গরু-মোষের ওপর হামলা চালানো শুরু করে। জঙ্গলে গরুর পালের ওপর হামলা চালিয়ে গরু মারতে বাঘের সমস্যা হতো না। কিন্তু মোষ দলে তিনটি থাকলেও এরা বাঘের ওপর পাল্টা হামলা চালিয়ে বাঘকে নাজেহাল করে দিত। শতাধিক গরু হারানোর পর গরুর মালিকেরা গরু ঢোকানো বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মোষ ঢুকতে থাকে।
বাঘগুলো তখন বিকেলের দিকে খড়মাখাল বরাবর টহল দিতে গিয়ে খালের ওপারেই গোহালগুলো খুঁজে পায়। জঙ্গলের প্রান্তে টহলের আর একটি বড় কারণ হলো এপ্রিল-মে মাসের প্রচন্ড দাবদাহের কবল থেকে বাঁচতে খোলা এলাকায় শরীর জুড়ানো। গ্রামে ঢুকে বাঘ প্রথমে কুকুর ধরে। তারপর ছাগল, হাঁস-মুরগি মেরে সাহস বাড়িয়ে গোহালে হানা দেয়। বাঘের একটি বদস্বভাব হলো, একটি গোহালে পাঁচটি গরু থাকলে পাঁচটিকেই মারবে, খাবার জন্য একটিকেই টেনে নেবে। গোহালে হামলা করার সময় অথবা ঘোরাঘুরি করার সময় মানুষ সামনে পড়ে গেলে বাঘ সেই বাধা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই হঠানোর চেষ্টাই মানুষের জন্য মারাত্মক। এই গরুমারা বাঘ এত ক্ষুধার্ত থাকে যে অনেক সময় মড়ি বা মৃতদেহ জঙ্গলে না নিয়ে অকুস্থলের কাছেই খেতে শুরু করে। সকালের দিকে গ্রামের মধ্যে মড়ি খাওয়ারত বাঘ দেখা গেলে জনতা যার যা আছে তাই নিয়ে বাঘ মারতে তেড়ে আসে। সাধারণত জঙ্গলের দিকটা ঘেরাও করে তাড়া দেওয়া হয়। বাঘ প্রাণের ভয়ে তখন উত্তরের ঘনবসতিতে চলে আসে। একসময় জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজনকে মারাত্মক আহত করার পর বাঘ নিজেও মারা পড়ে। ১৯৮৯ সালে হামলেপড়া চারটি বাঘের মধ্যে দুটি জনতার হাতে মারা পড়ে, একটি হাতায় গুলি খেয়ে ভয়ংকর মানুষখেকোতে পরিণত হয়ে প্রায় ৫৪টি মানুষ মারার পর ১৯৯৪ সালে সুর্যমুখী বন অফিসের কাছে এক বাওয়ালির কুড়ালের কোপে নিহত হয়। অন্যটির ভাগ্য জানতে পরিনি।
জিউধারা, কলমতেজি, ধানসাগর এলাকায় হামলা করার কারণ হচ্ছে ওই এলাকার জঙ্গলের ভেতর বেশ কিছুটা এলাকায় পানি আটকে পচে আছে। এই পানিতে গাছের পাতা পড়ে পচে জল কালো হয়ে গেছে, অত্যন্ত এসিডিক−গায়ে লাগলে চুলকালে ঘা হয়ে যায়। জঙ্গল গাছপালাশুন্য, জঙ্গলের প্রান্ত ফাঁকা। জঙ্গলের আব্রু বাঁচাতে বন বিভাগ আকাশিয়া পুঁতেছে। জঙ্গলে কিছু শুয়োর ছাড়া বাঘের শিকারযোগ্য পশু প্রায় নেই। স্থানীয়রা যথারীতি মোষ জঙ্গলে ঢোকায়। ২০০৩ সালের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ওই এলাকায় পাঁচটি বাঘ গ্রামবাসী মেরেছে।
বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের উত্তরাংশ গরান হেঁতালের অত্যন্ত ঠাসবুনটের জঙ্গলে হরিণের খাবার গাছপালা কম। কোয়ার ফাঁসজাল পেতে হরিণ মারার কয়েকটি দল আছে ওই এলাকায়। প্রতি অমাবস্যার গোনে তারা জঙ্গলে ট্রলার নিয়ে ঢোকে এবং হরিণ ফাঁকা করে দেয়। বাঘ বাধ্য হয়ে গ্রামে ঢোকে। এলাকার লোকজনের কাছে শুনেছি, ডিসেম্বর মাসে সরষে ফুল ফোটার সময় বাঘ গ্রামে বেশি ঢোকে। কতদুর সত্য পরখ করা হয়নি।
গণপিটুনিতে নিহত বাঘগুলোর যে কয়টির ময়না তদন্তের প্রতিবেদন বন বিভাগে দেখতে পেয়েছি, তাতে জেনেছি, বয়সে এরা নবীন-প্রবীণ, ভাগনে-খুঁড়ো সব বয়সীই আছে। বেশির ভাগ উঠতি বয়সী পুরুষ বাঘ। ভিসেরা প্রতিবেদনে সদ্য খাওয়া গরুর মাংস দু-একটির মধ্যে পাওয়া গেছে, বাকিগুলোর শুন্য পাকস্থলী। একটির পেটে সাপ পাওয়া গেছে।
২ জুলাই দুটি বাঘ মারা পড়াটা আশঙ্কাজনক। সব কয়টি বাঘের দেশেই এখনকার গণনায় বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক কম পাওয়া যাচ্ছে। বাঘের যে পাঁচটি উপপ্রজাতি টিকে আছে, তার মধ্যে সাইবেরীয় বাঘ ১৫০টি, দক্ষিণ চীনের বাঘ ৩০টি, ইন্দোচীনা বাঘ দেড় হাজার, সুমাত্রার বাঘ ২০০টি এবং বাংলার বাঘ আড়াই হাজার আছে বলে ধারণা করা হয়। সাম্প্রতিক গণনায় ভারতের বাকসা ও সারিস্কা টাইগার রিজার্ভে কোনো বাঘই পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সুন্দরবনে বছরে গড়ে তিনটি বাঘ গণপিটুনিতে, সাতটি শিকারিদের গুলিতে, বিষক্রিয়ায় মারা পড়ে।
সুন্দরবন কত দিন এ ক্ষতি সহ্য করতে পারবে সেটা ভবিষ্যৎ জানে। ভারতের সুন্দরবনের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোর জঙ্গলপ্রান্ত তারজাল দিয়ে ঘিরে উপকার পাওয়া গেছে। আমাদেরও লাগসই ব্যবস্থা খুব শিগগিরই নেওয়া দরকার।
সূত্র: প্রথম আলো, জুলাই ৭, ২০০৯
+ There are no comments
Add yours